নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতপাড়ায় প্রতারক টাউট বাটপারদের মহামারী ও আইনজীবী সমিতির নিয়মনীতিকে শিক্ষাণবিশদের তোয়াক্কা না করা সহ নানা অসঙ্গতি নিয়ে দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর টনক নড়েছে জেলা আইনজীবী সমিতির কর্তাদের। আদালতপাড়া থেকে টাউট বাটপার প্রতারক উচ্ছেদে অভিযানে যাওয়ার ঘোষণা করেছে সমিতি। একই সঙ্গে শিক্ষানবিশ ও আইনজীবী সহকারীদের কোর্টপাড়ায় নিয়মনীতি মেনে চলার জন্য কঠোর পদক্ষেপ আরোপ করা হয়েছে।
গত ২ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর ওই দিনই আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সরকার হুমায়ুন কবির ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এইচএম আনোয়ার প্রধান টাউট দালাল প্রতারক উচ্ছেদে এবং শিক্ষাণবিশ ও আইনজীবী সহকারীদের প্রতি কঠোর নিয়ম আরোপ করে নোটিশ প্রকাশ করে।
নোটিশে জানানো হয় যে, নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত প্রাঙ্গণকে দালাল ও টাউটমুক্ত করার লক্ষ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতি কর্তৃক দালাল ও টাউট উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা শুরু করা হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সহকারী/মুহুরী-দের অবশ্যই তাদের নির্ধারিত পোশাক ও গলায় আই.ডি কার্ড পরিধান করে এবং শিক্ষানবীশ আইনজীবী সদস্যদের অবশ্যই লাল টাই গলায় পরিধান করে আদালত প্রাঙ্গণে চলা ফেরা করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করা গেল।
সে প্রেক্ষিতে আগামী ০৬/০২/২০২৫ইং তারিখ হতে যদি কেউ নির্ধারিত পোশাক ও লাল টাই পরিধান ব্যতীত আদালত প্রাঙ্গণে চলা ফেরা করেন তাহলে তাহাকে টাউট হিসাবে চিহ্নিত করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহ টাউট হিসাবে চিহ্নিত করে ছবি সহ টাউটদের তালিকা টাঙ্গানো হবে।
পরবর্তীতে ৪ ফেব্রুয়ারি আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট মাঈনুদ্দীন আহমেদকে আহবায়ক ও সমিতির কোষাধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম মুক্তাকে সদস্য সচিব করে আদালতপাড়ায় টাউট দালাল উচ্ছেদ পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়।
ওইদিন এই কমিটিও একটি নোটিশ প্রকাশ করে জানায় যে, নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত প্রাঙ্গণকে দালাল ও টাউটমুক্ত করার লক্ষ্যে আদালত প্রাঙ্গণে বিজ্ঞ আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী (মুহুরী) ও শিক্ষানবীশ লাল টাই পরিহিত জুনিয়র ছাড়া অন্য কেহ কোন প্রকার নথি দেখতে পারবে না এবং মামলা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে কার্যক্রম করিতে পারিবে না। লাল টাই প্রাপ্ত শিক্ষানবীশ জুনিয়রদের সবসময় কোর্ট প্রাঙ্গণে লাল টাই অবশ্যই পরে থাকতে বাধ্য। মুহুরী/আইনজীবী ক্লার্কদের কোর্ট প্রাঙ্গনে অবশ্যই ড্রেস ও গলায় আইডি কার্ড পরিধান করে থাকতে হবে। যে কেহ গারদ থেকে কোন প্রকার ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিতে পারিবেন না। এই নির্দেশনা অমান্যকারীদের টাউট হিসাবে চিহ্নিত করে ছবি সহ টাউটদের তালিকায় টাঙ্গানো হবে। তবে এই দুটি নোটিশ প্রকাশের পরেও কোনো অভিযান দেখা যায়নি। পূর্বের ন্যায় চলছে আদালতপাড়ায় টাউট বাটপারদের কার্যক্রম।
অন্যদিকে আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতপাড়ায় প্রতারকের মহামারী আকার ধারণ করেছে। আইনজীবী সমিতির বর্তমান কার্যকরী পরিষদের কোনো তদারকি না থাকায় কোর্টপাড়ায় এখন প্রতারক দালালদের আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষ। গত ৫ আগস্টের পর স্বাধীন কোর্টপাড়ায় এখন দালাল চিটার বাটপার ও প্রতারকদের ব্যাপক আনাগোনা বেড়েছে। সমিতির বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট সরকার হুমায়ুন কবির ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এইচ.এম আনোয়ার প্রধান সহ সমিতির কর্তারা সেদিকে নজর দিচ্ছেন না।
কোর্টপাড়া সূত্রে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আইনজীবী সমিতিতে অ্যাডভোকেট হাসান ফেরদৌস জুয়েল ও অ্যাডভোকেট মোহসীন মিয়া নিয়মিত কোর্টপাড়া থেকে দালাল ও প্রতারক হটাতে অভিযান পরিচালনা করেছেন। যেসব শিক্ষাণবিশ বার কাউন্সিলের নির্ধারিত লাল টাই ও সাদা শার্ট পরিধান করেনি তাদেরকে কোর্ট থেকে বের করে দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে এক যুগ ধরে কোর্টপাড়ায় শিক্ষানবিশ, এমন ব্যক্তিরাও নিজেদের আইনজীবী পরিচয় দিয়ে বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। আইনজীবী না হয়েও আইনজীবী পরিচয় দিয়ে কোর্টপাড়া ধাবিয়ে বেড়াচ্ছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা হাজার খানিক ছাড়িয়েছে।
আইনজীবীদের অনেকেই জানিয়েছেন, দুপুরের পর থেকে বিভিন্ন থানা থেকে আসামিদের বহনকারী গাড়ি আনার সঙ্গে সঙ্গে কিছু দালাল গাড়ির দিকে ছুটে যায়। সেখান থেকে আসামীদের সাথে কথা বলে ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিয়ে মামলা আইনজীবীদের মাধ্যমে পরিচালনা করে আসছে দালাল শ্রেণির লোকজন। সিভিল কোর্ট ও ফৌজদারী আদালতে ভরপুর থেকে আইনজীবীদের বাহিরের লোকজন। অনেকেই কালো কোট পড়ে কোর্টে ঢুকে আইনজীবী পরিচয়ে। কিন্তু কার্যকরী পরিষদের শীর্ষ নেতারা কোনো তদারকিও করছেন না। লাগামহীন ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে কোর্টপাড়া। কে আইনজীবী এবং কে আইনজীবী নন সেটা বুঝতে পারছেনা বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষ। কোর্টপাড়ায় শুধুমাত্র কালো কোর্ট ও সাদা শার্ট পরিধান করে আইনজীবী সেজে কোর্টে কাজ করছে হাজারের অধিক ব্যক্তি।
আইনজীবীরা আরো জানান, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৫ সেপ্টেম্বর বর্তমান পরিষদ আইনজীবী সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৭ জনের পরিষদ বিএনপি ও জামাতের আইনজীবীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তায় নির্বাচিত হোন। এরি মাঝে এক দফা শিক্ষানবিশদের ভাইভা নেয়া হয়েছে। লাল টাই দেয়া হলেও কেউই লাল টাই পড়ছেনা বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষ শিক্ষানবিশ হিসেবে চিনে ফেলবে বিধায়। কালো কোর্ট ও সাদা শাট পরিধান করলে বিচার প্রার্থী ও সাধারণ মানুষের মাঝে আইনজীবী পরিচয় দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় না দিলেও বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষ ধরেই নেয় তিনিও আইনজীবী।
আশ্চর্য্যের বিষয় হলো- কোর্টপাড়ায় আইনজীবী সমিতির ১৭ জনের মধ্যে যাদের সাথে শিক্ষাণবিশ রয়েছেন, পিপি স্পেশাল পিপি জিপি অতিরিক্ত পিপিদের মধ্যে যাদের সঙ্গে শিক্ষাণবিশ রয়েছেন তারাই বার কাউন্সিলের নির্দেশমতে লাল টাই পরিধান করছে না। তারা আইনজীবী হওয়ার আগেই আইনজীবী পরিচয় দিচ্ছেন কোর্টপাড়ায়। এ ছাড়াও কোর্টপাড়ায় কোর্ট ফি, ওকালতনামা, বেলবন্ড যাচাই বাচাই অভিযান পরিচালনা করছেন না। প্রতিটা কোর্টে অপরিচিত কিংবা আইনজীবীদের বাহিরের লোকজনকে দেখলেও সমিতির নেতারা তাদেরকে কিছুই বলছেন না।
আপনার মতামত লিখুন :